প্রগতিশীল আন্দোলনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে উজ্জীবিত করছে



স্বাধীনতার সমবয়সী দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জল অবদান রয়েছে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে। আভ্যন্তরীণ এবং জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 

শিবির, খুনি-ধর্ষক এবং যৌন নিপীড়ন বিরোধীসহ বিভিন্ন আন্দোলনের অধিকাংশই পেয়েছে সফল পরিণতি। সারা দেশে পরিচিত হয়েছে ‘প্রতিবাদের ক্যাম্পাস’ নামে। জাবির প্রগতিশীল আন্দোলনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আলাদা চরিত্র দিয়েছে এবং উজ্জীবিত করে আসছে।

রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন মনে করেন, এসব প্রগতিশীল আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি শক্ত সাংস্কৃতিক ভিত্তি দিয়েছে। পাশাপাশি একটি মুক্তচিন্তার কেন্দ্র হিসেবে সর্বমহলে মর্যাদাকর পরিচিতি পেয়েছে।

জাবির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাসিম আখতার বিশ্ববিদ্যালটির শুরুর সময় থেকে শিক্ষকতা করছেন। ক্যাম্পাসে ঘটা প্রায় সবগুলো প্রগতিশীল আন্দোলন নিয়ে তার সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রগতিশীল আন্দোলনে জাবির অবদান জানতে চাইলে সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলেন তিনি। প্রথমেই জানালেন, স্বাধীনতার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা। 

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রগতিশীল আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার হাতেখড়ি হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, বলেন তিনি। 

তবে অধ্যাপক নাসিমের মতে, প্রতিষ্ঠার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রথম প্রগতিশীল জাগরণ ঘটে শিবির বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে।

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “আশির দশকে সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের আমলে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবির সারা দেশে তাদের ডালপালা ছড়ায়। এর অংশ হিসেবে জাবিতেও অবস্থান নেয় শিবির, যা ক্যাম্পাসের কোন সংগঠনই ভালোভাবে নেয়নি। এর মাঝে ১৯৮৯ সালে শিবিরের হাতে খুন হন ছাত্রদল নেতা ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হাবিবুর রহমান কবির। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসের সব ছাত্র সংগঠন ‘সর্বদলীয় ঐক্য’ গঠন করে শিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যা এখনো বলবৎ আছে।”

“ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রফ্রন্ট, জাবি সাংস্কৃতিক জোটসহ ক্যাম্পাসের সব সংগঠন মিলে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সেই ‘সর্বদলীয় ঐক্য’ গড়ে তুলেছিলো।”

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, জাবিতে শিবির নিষিদ্ধের ঘটনা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে আছে। 

এর কারণ ব্যাখ্যায় জাবির অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “আশির দশকে সারা দেশে যখন স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবিরকে পুনর্বাসিত করা হচ্ছিলো। সেই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা অবশ্যই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখা হয়েছে।”

ছাত্র আন্দোলনে মৌলবাদী শিবিরের অপসারণ ঘটলেও ক্যাম্পাসে রয়ে যায় খুনি-ধর্ষকদের দাপট। ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে তা উদযাপনের সংবাদ আসে পত্রিকায়। প্রতিবাদে সরব হয় শিক্ষার্থীরা; শিক্ষকদের একটা বড় অংশ সমর্থন দেয় আন্দোলনে। ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করা হয় খুনি ও ধর্ষকদের। ১৯৯৯ সালের ২রা আগস্টের সেই ঘটনাকে খুনি-ধর্ষক বিরোধী দিবস হিসেবে আজো স্মরণ করে শিক্ষার্থীরা। 


ধর্ষকদের শাস্তি দাবিতে সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে ছাত্রীদের অবস্থান, 
ছবি- রাশেদ মেহেদী

খুনি-ধর্ষক বিরোধী সেই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন জাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী। তিনি পরবর্তীতে এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘গণি আদমের ক্যাম্পাস’ নামে একটি উপন্যাসও লেখেন। 

শিক্ষার্থীদের সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “১৯৯৮ সালে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মানিক ও তার সঙ্গীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মুখে বহিস্কৃত ও বিতাড়িত হয়। হলের দখল নেয় প্রতিপক্ষ ‘খুনি গ্রুপ’। পরের বছর আগস্টের শুরুতে ধর্ষক গ্রুপ প্রত্যাবর্তন করলে শিক্ষার্থীদের এক অভ্যুত্থানে অভিযুক্তরা পুনরায় বিতাড়িত হয়।”

আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কতিপয় শিক্ষকের বিরোধিতার কথা জানিয়ে রাশেদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সে সময় আমরা আন্দোলন করেছিলাম। প্রশাসনিক ভবনের সামনে তৎকালীন উপাচার্য ধর্ষকদের বাঁচাতে কে ধর্ষিতা তা জানতে চাইলে শত শত ছাত্রী হাত তুলে বলেছিলো, ‘আমি ধর্ষিতা’। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বিশেষ করে বিশেষ করে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আন্দোলনটিকে গণ আন্দোলনে রূপ দেয়।

ধর্ষণ বিরোধী এই আন্দোলন পরবর্তীতে বীজ বুনে দেয় যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের। কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে আবার সরব হয় শিক্ষার্থীরা। নিপীড়নের বিচার করতে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা নিয়ে নিশ্চুপ থাকলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। মহামান্য হাইকোর্ট নীতিমালাটি গ্রহণ করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। 

যৌন নিপীড়ন বিরোধী এই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন। এই ঘটনাকে যৌন নিপীড়ন বন্ধে একটি ‘বড় পদক্ষেপ’ হিসেবে মনে করেন রাজনীতির এই অধ্যাপক। 

“জাবির এই আন্দোলন সারা দেশে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা সোচ্চার আওয়াজ তুলতে পেরেছিলো, বিশেষ করে নারীদের মাঝে। আন্দোলনের ফসল হিসেবে পাওয়া যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা ও সেলের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে অনেক ঘটনার বিচার হয়েছে”, বলেন তিনি। 

প্রগতির পতাকাবাহী এসব আন্দোলনের পাশাপাশি আশির দশকে জাতীয় পর্যায়ে হওয়া দুটি আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগরের সোচ্চার ভূমিকার কথা স্মরণ করেন অধ্যাপক নাসিম আখতার। 
তিনি বলেন, “সামরিক শাসক এরশাদের সময়ে সংগঠিত শিক্ষা আন্দোলন এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা নানা নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলন করে গেছেন।”

হত্যা-সহিংসতার বিরুদ্ধে সব সময়েই জাবির একটা শক্ত অবস্থান ছিলো। প্রতিষ্ঠার চার দশকে রাজনৈতিক কোন্দলে নিহত হয়েছেন চারজন ছাত্র। প্রগতি বিরোধী এসব হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রতিবারই হয়েছে প্রতিবাদ। সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রতিপক্ষের হামলায় ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদ নিহত হলে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনে নামে প্রগতিশীল সংগঠনগুলো।

এই আন্দোলনের মুখপাত্র জাবি সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাকিলা শারমিন বলেন, “মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই ক্যাম্পাসে কোন হত্যাকা- আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই পেশি শক্তির বিপরীতে শান্তির বার্তা দিতে আমরা আন্দোলনে নামি। সফলও হয়েছিলাম আমরা। অপরাধীরা বহিস্কার হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আদালত দিয়েছে শাস্তি।”



জুবায়ের হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল, ছবি- ইমদাদ হক 

দুর্নীতির এবং দুর্নীতিগ্রস্থ লোকদের বিরুদ্ধে এই ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আছে উচ্চকিত আওয়াজের ইতিহাস। সর্বশেষ থার্মেক্স গ্রুপের মালিক কাদির মোল্লার অর্থায়নে ‘কাদির মোল্লা কনভেনশন সেন্টার’ তৈরির বিরোধীতায় নামে শিক্ষার্থীরা। সে ইতিহাসের কথাই জানালেন ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের বর্তমান সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয়।

চারুকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, “যখনই দুর্নীতি দেখেছি, আমরা প্রতিবাদ করেছি। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা কাদির মোল্লার টাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন স্থাপনা আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আন্দোলন করে সেই স্থাপনা নির্মাণ চেষ্টা রুখে দিয়েছি।”

অধ্যাপক নাসিম আখতার বলেন, “এসব আভ্যন্তরীণ ঘটনা ছাড়াও শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ, তনু হত্যা, পাহাড়ে আদিবাসী এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নির্যাতন, যৌন নিপীড়নের ঘটনাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিলো।”

অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জাবির এসব প্রগতিশীল আন্দোলনকে সব সময় নেন অনুপ্রেরণা হিসেবে।

সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান গর্ব করে বলেন, “প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই ক্যাম্পাসের অনেক বিষয় নিয়েই আমরা গর্ব করি। তার মধ্যে প্রগতিশীল আন্দোলনগুলো আমাদের বিশেষভাবে নাড়া দেয়।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম মনে করেন, ক্যাম্পাসের আবাসিক চরিত্র এসব প্রগতিশীল আন্দোলনকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। 

প্রগতিশীল আন্দোলনে জাবির অবদান নিয়ে জানতে চাইলে নৃবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে জন্ম নেয়া এই বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ধারণ করে আছে। এজন্যই যখনই অন্যায় হয় তখনই এখানে প্রতিবাদ-আন্দোলন হয়।”

“চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল ক্যাম্পাস হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে জাবি। প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে অধিকার আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়। আর আমি মনে করি এই প্রতিবাদী মুখগুলোই তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

জাবির প্রগতিশীল আন্দোলনের পর্যালোচনা তাই বলে, পরম্পরায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রগতিশীল আন্দোলনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এবং সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রকেত্যকটি প্রগতিশীল আন্দোলনে তারা সফলতার মুখও দেখেছে। এসব প্রগতিশীল আন্দোলই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে উজ্জীবিত করছে। 

Comments

Popular posts from this blog

গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি কী?

গণমাধ্যমের প্রচারণা মডেল ও ফিল্টার

সামাজিক স্তরবিন্যাস