গণমাধ্যমের প্রচারণা মডেল ও ফিল্টার
সংবাদ মাধ্যমের সকল খবর এক ধরনের ছাঁকন-প্রণালীর মধ্য দিয়ে পরিশোধিত হয়ে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছায়। সেন্সরশিপের এই সীমাটি কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিরোধী কোনো রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন কিংবা মিডিয়ার নিজের দিক থেকেও কোন সেন্সর দ্বারা নির্ধারণ হয় না। বরং আর্থ-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিডিয়ার যে গড়ন-কাঠামো সেই কাঠামোর খুঁটিগুলোই নির্ধারণ করে দেয় কী ছাপা যাবে আর কী ছাপা যাবে না।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন স্কুলের ফিন্যান্সের অধ্যাপক এডওয়ার্ড হারম্যান এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অভ টেকলোনজির ভাষাতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক নোম চমস্কি কর্পোরেট সাংবাদিকতার এই দিকটিকে তাদের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য ম্যাস মিডিয়া’ বইতে ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে তারা ‘মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রচারণা মডেল’ উপস্থাপন করে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে পাঁচটি ফিল্টারের কথা বলেন। তারা আমেরিকার প্রেক্ষাপটে এই মডেলটি আলোচনা করলেও তা এখন বিশ্বের সর্বত্র প্রযোজ্য হচ্ছে।
তারা এই বইতে দেখিয়েছেন মার্কিন মিডিয়ার মতপ্রকাশের আঙিনাটি আসলে খুব সংকীর্ণ একটি গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঐ সীমার মধ্যে যেসব মতামত থাকে, কেবল সেগুলোই তারা প্রকাশ করেন। সীমার বাইরে গেলেই কোনো মত আর প্রকাশিত হয় না। সেন্সরড হয়।
প্রচারণা মডেলে ফিল্টার
মালিকানা-মুনাফা-ব্যবসা, আয় হিসেবে বিজ্ঞাপন, বিশেষজ্ঞ-নির্ভরতা, ফ্লাক এবং কর্পোরেট মতাদর্শ। কর্পোরেট মিডিয়ার এই পাঁচ খুঁটি বা পাঁচ বৈশিষ্ট্যকে চমস্কি-হারম্যান আখ্যায়িত করেছেন পাঁচ ‘ফিল্টার’ হিসেবে। সংবাদের বা মতামতের কাঁচামালকে অবশ্যই এসব ধারাবাহিক ফিল্টারের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পরিশেষে পড়ে থাকে কেবল সেই ‘পরিচ্ছন্ন’ তলানিটুকু, যা ছাপার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এ পর্যায়ে এই পাঁচটি ফিল্টার সম্পর্কে বলা যাক।
প্রথমেই যে ফিল্টার আছে তা হল মালিক-মুনাফা-ব্যাবসা। মালিকানার দিক দিয়ে মিডিয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত, বেসরকারী ও রাজনৈতিক- এই তিন ধরনের হয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেকোন মিডিয়ার প্রধান তাড়না মুনাফা অর্জন। খরচ কমানো এবং আয় বাড়ানোই মিডিয়া মালিকদের মূল লক্ষ্য। তাহলে ব্যবসা নামক জিনিসটার স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কিছুকি এখানে ছাপানো সম্ভব?
দ্বিতীয় ফিল্টার হল বিজ্ঞাপন ব্যাবসা করার লাইসেন্স। কর্পোরেট মিডিয়ার আয়ের প্রাথমিক উৎস হচ্ছে বিজ্ঞাপন। মিডিয়া এর পাঠকগোষ্ঠীকে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে দেয় টাকার বিনিময়ে। যার পাঠক-দর্শক-শ্রোতা বেশি তার বিজ্ঞাপন বেশি, টাকা বেশি। তাই যেভাবেই হোক, যে উপায়েই হোক, পাঠক-দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা বাড়ানো দরকার। আর এ জন্য সস্তা ধরনের, বাজারে কাটতি পাবে এমন সংবাদই বেছে বেছে ছাপানো হয়। ফলে জনস্বার্থ নিয়ে সংবাদ বাদ পরে যায়। তাই নিজেই নিজের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা ছাড়া তখন আর কোন পথ থাকে না।
তৃতীয় যে ফিল্টারটিকে চমস্কি-হারম্যান শনাক্ত করেছেন তা হলো ‘বিশেষজ্ঞদের’ দেয়া তথ্যের ওপর মিডিয়ার নিরুপায় নির্ভরশীলতা। অন্যভাবে বলা যায় গণমাধ্যমের জন্য সংবাদ উৎপাদন। এসব ‘বিশেষজ্ঞরা’ আসলে সরকার, ব্যবসায়ী মহল এবং কে›ন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিশেষ পছন্দের বুদ্ধিবৃত্তিক এজেন্ট মাত্র। এরা সব কেউ লাল রঙের কেউ বা নীল, কিন্তু আদতে একই পদার্থ। এছাড়া যদি সারাদেশ থেকে দরকারি খবর জোগাড় করে সেগুলোর সত্যিকারের বিশ্লেষণ পেশ করতে হয় তাহলে তো হাজার হাজার সংবাদদাতা, শত শত বিশ্লেষক দরকার পড়বে। খরচের সীমা-পরিসীমা থাকবে না। সুতরাং সমাজে যা-ই ঘটুক না কেন, ধূর্ত শেয়াল কর্তৃক বোকা কুমিরকে একই ছানা বারবার দেখানোর মতো হাতেগোনা দু-এক ডজন ‘বিশেষজ্ঞ’কে ক্রমাগতভাবে হাজির করে কর্পোরেট মিডিয়া।
কর্পোরেট মিডিয়ার চতুর্থ ফিল্টার হচ্ছে ‘ফ্ল্যাক’। সাংবাদিকতা বিষয়ক নানা বিভাগ, নানান প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পুরস্কার-তিরস্কার, মামলা, সংসদে বিল উত্থাপন, সাংবাদিকতা-বিশেষজ্ঞদের লেখাপত্র এবং তাদের টকশো ইত্যাদির মাধ্যমে মিডিয়াকে ‘নিয়মানুবর্তিতা’ শিক্ষা দেয়ার হাতিয়ার হচ্ছে ‘ফ্ল্যাক’। এতেকরে তথাকথিত ‘বিভ্রান্তিকর’ যাবতীয় কিছুই মিডিয়াতে প্রকাশের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
কর্পোরেট মিডিয়ার সর্বশেষ ও পঞ্চম ফিল্টারটি হল তার ‘কর্পোরেট মতাদর্শ’। কখনো ‘কমিউনিজম-বিরোধিতা’, কখনও ‘সন্ত্রাসবাদ-বিরোধিতা’, কখনো ‘ইসলাম-বিরোধিতা’র মতাদর্শ। আবার কখনও ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র প্রতি ঢালাও সমর্থনের মতাদর্শ। এসব মতাদর্শ হচ্ছে মুনাফার ধর্ম, সেন্সরশিপের ধর্ম, কর্পোরেট মিডিয়ার ধর্ম। সুতরাং রাষ্ট্র-কর্পোরেট সেক্যুলার ধর্মের বাইরের ‘বিধর্মী’ কোনো মতামত-খবর মিডিয়ার কাছে ¯্রফে ‘নাস্তিকতা’, যার জন্য সেন্সরশিপ ছাড়া উপায় থাকে না!
আজকের বাংলাদেশেও কর্পোরেট মিডিয়ার যুগ চলছে। এখানেও সব সংবাদ এই ফিল্টার পেরিয়ে জনসম্মুখে আসে। আমাদের কর্পোরেট মিডিয়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ লিবারাল বা মুক্তবাজার মিডিয়ার মতোই ‘স্বাধীন’ ও ‘শক্তিশালী’ হয়ে উঠেছে।
প্রচারণা মডেলের ফিল্টারগুলোর পরিণামেই সমাজে গড়ে ওঠে এলিট-একাধিপত্য এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের কোণঠাসা করার যন্ত্রমন্ত্র-কলাকৌশল। গোটা প্রক্রিয়াটি চলে মুক্তবাজারের নিয়মেই; এবং তা এতই ‘স্বাভাবিক’ একটা প্রক্রিয়া যে সাংবাদিকরা সাধারণত টেরই পান না যে, তারা কোনো সেন্সরড প্রচারণা-সিস্টেমের ভেতরে কাজ করছেন।
সুতরাং বলা যায়, এই ফিল্টারগুলোই সমাজে বিদ্যমান আলাপ-আলোচনা-তৎপরতার বা ডিসকোর্সের ভিত্তিমূল। এই মূলের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে খোদ সংবাদ ও মত প্রকাশের সংজ্ঞা। কাজেই এই পুরো প্রক্রিয়াটা ‘সাংবাদিকতা’ নামক যে জিনিস উৎপন্ন করে, তা আসলে বড়লোক শ্রেণির ধ্যান-ধারণা ও সমাজবিন্যাসের সপক্ষে পরিচালিত প্রোপাগান্ডা ছাড়া কিছুই না। কর্পোরেট সাংবাদিকতার এই মডেলটিকে চমস্কি-হারম্যান তাই আখ্যায়িত করেছেন ‘প্রচারণা মডেল’ নামে।