সামাজিক স্তরবিন্যাস



মাজস্থ ব্যক্তিবর্গকে উচ্চ-নীচু পর্যায়ে বিভক্ত করাকেই বলে সামাজিক স্তরবিন্যাস। মানব সমাজ সহজাতভাবেই বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। সমাজব্যবস্থার অর্šÍভুক্ত ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করলে তাদের মাঝে গড়ে ওঠে ক্ষমতা ও মর্যাদার এক সেপান। একেই বলে সামাজিক স্তরবিন্যাস।
 

বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন- সরোকিন বলেছেন, “নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীর উঁচু-নীচু অবস্থানের ভিত্তিতে শ্রেণীসমূহের মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তাকে সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে।”
 

সমাজবিজ্ঞানী বটোমোর বলেছেন, “Social stratification is the division of society into classes of strata, which form a hierarchy of prestige and power,....
 

রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্তরবিন্যাসের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে থাকেন। মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত, স্তরবিন্যাস মানব সমাজের কোন স্থায়ী বা শ্বাশ্বত বিষয় নয়। আর ক্রিয়াবাদীদের অভিমত, মানব সমাজে স্তরবিন্যাস হল অবধারিত, অপরিহার্য এবং শ্বাশ্বত। 


 


রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনায় স্তরবিন্যাসের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়েছে সমাজজীবনের সূত্রপাত থেকেই। এদের মাঝে আবার অনেকেই মনে করেন, সমাজজীবনে স্বাভাবিক কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে স্তরবিন্যাসের গুরুত্ব রয়েছে।
 

সামাজিক স্তরবিন্যাস হল একটি সমাজিক সিঁড়ি। এই সিঁড়ির যে যত উচ্চধাপে অবস্থিত, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও মান-মর্যাদা তার তত বেশি। এ কারণে অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস বলতে মর্যাদা অনুযায়ী স্তরবিভাগকে বোঝায়। এই মর্যাদাবোধের ভিত্তি হল আর্থ-রাজনীতিক অথবা পুরোহিততান্ত্রিক ক্ষমতা।
 

মানব সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে অসাম্য বা স্তরভেদ দেখা যায় তা মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একপ্রকার হচ্ছে বংশগত বা আরোপিত এবং অন্যটি হল অর্জিত। সমাজে জন্মগত কারণে বা বংশগত কারণে মানুষে-মানুষে পার্থক্য তৈরি হয়। আবার ব্যক্তির নিজস্ব উদ্যোগে অর্জিত গুনগত যোগ্যতার ভিত্তিতেও সামাজিক স্তরভেদের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বৈষম্য হল সমাজের সৃষ্টি।
 
উদাহরণ হিসেবে হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার কথা বলা যেতে পারে। হিন্দু সমাজে জন্মগতভাবে যে ব্যক্তি যে অবস্থানে থাকে, তাকে সারাজীবন সেই অবস্থান স্বীকার করে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। আবার জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তিকে সমাজে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করা হয়, যা ব্যক্তির নিজের উদ্যোগে অর্জিত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা সম্পদ সামগ্রীর পরিপ্রেক্ষিতে এরকম উদাহরণের অভাব নেই। 



সামাজিক স্তরবিন্যাসের সঙ্গে সমাজিকীকরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। স্তরবিন্যাসের কার্যকারিতা সামাজিকীকরণের ওপর বহুলাংশে নির্ভশীল। তেমনি সামাজিক স্তরবিন্যাস আবার সমাজের এইসব বিধিব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
মানব সমাজে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মের সঙ্গে মান-মর্যাদা, আর্থিক প্রাপ্তি, অবকাশ ভোগ ইত্যাদি নানা সুযোগ-সুবিধা যুক্ত থাকে। ফলে কাজের গুরুত্ব ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারতম্যের সৃষ্টি হয়। মার্কসীয় দর্শনে এবং ম্যক্স ওয়েবারের বিশ্লেষণে সমাজের স্তর বিন্যাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
 


সামাজিক স্তরবিন্যাসকে আবার মার্কসবাদী তথা দ্বান্দিক ও ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে সামাজিক মানুষের বিভাজন। আর এ বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই বিভাজন হচ্ছে মানবসৃষ্ট, চাইলেই এই বিভাজন সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক স্তরবিন্যাসের ভিত্তি হচ্ছে সম্পত্তি, ক্ষমতা ও মর্যাদা। মার্কসের মতে সমাজে স্তরবিন্যাসের উদ্ভব হয়েছে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাকে কেন্দ্র করে। তাই ব্যক্তিগত মালিকানার অবলুপ্তি ঘটলে স্তরবিন্যাসেরও অবসান ঘটবে। 






অন্যদিকে ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ডেভিস ম্যুর মনে করেন, সামাজিক স্তর বিন্যাস হচ্ছে সামাজিক মানুষের বিভক্তি। এর মূলে রয়েছে মানুষের বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়া। সমাজের এই বিভাজন অপরিহার্য এবং শ্বাশ্বত। সুতরাং স্তরবিন্যাস নিয়ে মার্কসবাদীদের বক্তব্য ও মার্কসবাদ বিরোধী তথা ক্রিয়াাবাদীদের বক্তব্য অনেকটা পরস্পর বিরোধী।
সমাজিক স্তরবিন্যাসের পেছনে অর্থনীতি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কিন্তু একমাত্র নয়। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও সামাজিক স্তরবিন্যাস সৃষ্টি হতে পারে। কেবলমাত্র ধর্মীয় কারনেই সমাজের মানুষের মধ্যে স্তরবিন্যাস তৈরি হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমার ভারতবর্ষের কথা বলতে পারি। এক্ষেত্রে পোল্যান্ডের নজির অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও এই সমাজতান্ত্রিক দেশটি ধর্মযাজকদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
 


সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিরোধিতা করে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যক্তির মেধা শক্তির বিকাশে সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে সমাজের সকল সৃজনী শক্তিকে প্রগতিশীল ও উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা যায় না। সামাজিক স্তরবিন্যাসের কারণে সমাজজীবনে রক্ষণশীলতা প্রশ্রয় পায়। সামাজিক সংহতির সম্ভাবনা স্তরবিন্যাস দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আবার চিন্তাবিদদের অনেকে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ইতিবাচক দিকটির ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তাদের মতে, সাামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজের প্রগতিশীল ধারাটিকে প্রবাহিত রাখে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় যাদের অবস্থান অস্বাচ্ছন্দপূর্ণ তারা অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থার জন্য পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। এতে করে সমাজের গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে।

 
সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন
কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক স্তরবিন্যাসের আকৃতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক স্তরবিন্যাসের নিন্মোক্ত চারটি ধরনের উল্লেখ করেছেন। যথা- ক) দাস ব্যবস্থা, খ) সামন্ত বা এস্টেট ব্যবস্থা, গ) শ্রেণী ব্যবস্থা এবং ঘ) বর্ণ বা জাতিপ্রথা।
 

দাস ব্যবস্থা
সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রথম এবং প্রধান প্রকরণ হচ্ছে দাস ব্যবস্থা। এটিই প্রথম শ্রেণীভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। গোড়ার দিকে যখন ব্যক্তি মালিকানার প্রচলন হয় তখন সম্পত্তি দখলের জন্য পরিচালিত যুদ্ধে পরাজিত সৈন্যদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হত।
 
দাস ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যুশম্যান বলেছেন, “দাস ব্যবস্থা একজন মানুষকে অপর একজন মানুষের ওপর মালিকানা আরোপের অধিকার দেয়।” মার্কসের মতে, দাস ব্যবস্থাই প্রথম শ্রেণীভিত্তিক শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা।
 

এস্টেট ব্যবস্থা
ভূমিস্বত্বকেই ইংরেজিতে বলা হয় ‘Estates’। যার অর্থ জমিদারের মালিকানাধীন জমি। মধ্যযুগে ইউরোপে ও রাশিয়ায় এস্টেট ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় কোন দল বা ব্যক্তি রাষ্ট্র থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূখন্ড পেয়ে তাতে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। এস্টেট ব্যবস্থায় তিন সামাজিক স্তর বিন্যাস পরিচালিত ছিল। যথা- যাজক শ্রেণী, অভিজাত শ্রেণী এবং সাধারণ শ্রেণী। এদের সম্পর্কে বটমোর বলেছেন, ‘অভিজাত শ্রেণী সবার ভাগ্য নির্ধারণ ও নিরাপত্তা বিধান করে, যাজক শ্রেণী সবার জন্য প্রর্থনা করে এবং সাধারণ শ্রেণী সবার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে।
 




বর্ণ প্রথা
বর্ণ বা জাতি প্রথার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Caste’ শব্দটি এসেছে পর্তুগীজ শব্দ ‘Casta’ থেকে, যার অর্থ বংশধর, কূল বা জাতি। সুতরাং জাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে সৃষ্ট বিভাজন হচ্ছে বর্ণপ্রথা। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এ প্রথার প্রচলন রয়েছে। তবে এই প্রথা কিছু পরিবর্তিত রূপে অন্য অঞ্চল বা ধর্মের লোকদের মধ্যেও দেখা যায় বলে সমাজবিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছেন।
 
বর্ণপ্রথা সম্পর্কে রিজলী বলেছেন, বর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে কতকগুলো পরিবারের সমষ্টি, যাদের একটি অভিন্ন পদবী আছে এবং যারা একটা অভিন্ন বংশধারার সাথে পরিচিত। হিন্দুদের ধর্মীয় শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র এই চারটি বর্ণের উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখিত চারটি বর্ণ আবার অসংখ্য উপবর্ণে বিভক্ত।
 




শ্রেণী ব্যবস্থা
সামাজিক শ্রেণী সমাজবিজ্ঞানের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এটি প্রথম কে কখন ব্যবহার করেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে জর্মান পন্ডিত র্কাল মার্কস শব্দটির সর্র্বাধিক ব্যবহার করেন। শ্রেণী সম্পর্কে লেলিন বলেছেন, ‘শ্রেণী হচ্ছে পরস্পর বিপরীত স্বার্থ নির্ভর দু’টি গোষ্ঠী, যাদের এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে শোষণ করে।’ শ্রেণী ব্যবস্থাকে সমাজবিজ্ঞানীরা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণী- এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। উচ্চবিত্ত হচ্ছে যাঁরা অধিক সম্পদের মালিক। মধ্যবিত্ত হচ্ছে যাদের খুব বেশি সম্পত্তি নেই, কিন্তু অন্যের সাহায্য গ্রহণেরও প্রয়োজন হয় না। আর নিম্নবিত্ত হচ্ছে শ্রমজীবি শ্রেণী, যাদের তেমন কোন অর্থ সম্পত্তি নেই।
 


সামাজিক স্তরবিন্যাসকে পরিপূর্ণ অবসান করা অসম্ভব। কারণ প্রকৃতিই সকল ক্ষেত্রে সাম্যের সমর্থক নয়। তবে যে অসাম্য বা স্তরবিন্যাস আরোপিত হয় তার অবসান সম্ভব ও বাঞ্ছনীয়। একথা অস্বীকার করা যাবে না। তাই স্বভাবতই সমাজব্যবস্থার মধ্যে সাম্য ও অসাম্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিষয়টি বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। কোন একক কারণে এর সৃষ্টি হয়না বা হয়নি। সমাজের মানুষের জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে স্তরবিন্যাসের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। 

Comments

  1. tnx অনেক উপক্রিত হলাম

    ReplyDelete
  2. সামাজিক স্তরবিন্যাসে ম্যাকাওয়াইবের তত্ত্বটি দেন।

    ReplyDelete
  3. সমাজকর্মীদের জন্য সামাজিক স্তরবিন্যাস অনুধ্যান গুরুত্বপূর্ণ কেন?এই প্রশ্নের উত্তর টা দেন

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি কী?

গণমাধ্যমের প্রচারণা মডেল ও ফিল্টার