লাল-সবুজের শিক্ষা নগরী


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত দুটি দিক দিয়ে আমাকে বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর প্রথমটি হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে। আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপরই ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি থেকে শুরু হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। তাই বলা যায়, স্বাধীনতার প্রায় সমবয়সী এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যেন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের স্মারক হিসেবে ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, এই ক্যাম্পাসের লাল দালান আর সবুজ প্রকৃতি যেন লাল-সবুজের বাংলাদেশকেই আমার সামনে ফুটিয়ে তোলে।   


এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে। এই অ্যধ্যাদেশকে বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে অন্যতম সেরা অর্জন। কারণ এই অধ্যাদেশের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে স্বায়ত্তশাসন, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামো ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।

প্রকৃতির সবুজ চাদরে মোড়ানো এই বিশ্ববিদ্যালয় বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল ক্যাম্পাস হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে অধিকার আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়। এজন্য বিভিন্ন সময়ে ‘যৌক্তিক’ কিংবা ‘অযৌক্তিক’ দাবিতে বারবার ক্যাম্পাসে হয়েছে আন্দেলন। এ যেন কেবল আন্দোলনেরই ক্যাম্পাস! আজ তেমন কিছু আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও ফলাফল নিয়ে লিখছি।

বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরুর পর জাবি প্রথম সংকটে পড়ে ১৯৮৯ সালে স্বাধীনতা বিরোধী শিবির জাবিকে প্রায় দখল করে ফেলেছিল কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রী আর সর্বদলীয় ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিরোধের তারা পিছু হটে, সেসময় শিবিরের আক্রমনে শহীদ হন ছাত্রদল নেতা ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হাবিবুর রহমান কবির তারপর সবসংগঠন মিলে জাবিতে শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়, আজও তারা জাবিতে নিষিদ্ধ আর নিহত সেই কবিরের স্মরণে জাবির নতুন প্রশাসনিক ভবন থেকে আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের দিকের যাওয়ার রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে কবীর স্মরণী।

এরপরের শিক্ষার্থী খুনের ঘটনাটিতেও শিবিরের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশে তখন টানটান উত্তেজনা। ১৯৯৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে ধরা পরে যায় শিবিরের এক ‘সাথী’। তাকে মারধর করে জিজ্ঞাসাবাদ করার একপর্যায়ে সে অসুস্থ্য হয়ে যায়। পরে জানা যায়, কিছুদিন আগে তার বাইপাস সার্জারী হয়েছিলো। এ ঘটনায় অসুস্থ্য হয়ে ঐ ছেলে মারা যায়। ঘটনাটি ঘটেছিলো ছাত্রদল নেতা শওকত কবীর দিপুর কক্ষে। পরবর্তীতে ছাত্রদলের প্রতিপক্ষের সাথে রাজনৈতিক সুবিধা করতে না পেরে ১৫ নভেম্বর ১৯৯৪ সালে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বিডিএটিসির সামনে তাকে কোপানো অবস্থায় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ২৩ নভেম্বর তিনি মারা যান।

আবার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খুনে ঘটনা ঘটে ২০১২ সালে। সে বছরের ৮ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে নিজের সংগঠন ছাত্রলীগের এক পক্ষের হামলায় আহত জুবায়ের পরদিন মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের এই ছাত্র ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্রলীগে যুক্ত ছিলেনপরবর্তীতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন ও রাষ্ট্রীয় আদালতে খুনিদের সাজা হয়েছিলো, যদিও রায় কার্যকর হয়নি এখনো।


এরআগে আন্দোলনের আরেকটি সোনালী অধ্যায় আছে। সেটা ছিলো ছাত্রলীগ নেতা সেঞ্চুরি মানিকের উত্থান নিয়ে আন্দোলন। সময়টা ১৯৯৮ সাল। বিশবিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নাকানি-চুবানি অবস্থা। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের থেকে বাইরের লোকদের আনাগোনা ও পদচারণা বেশি। কেউ ভয়ে কিছু বলছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘র‌্যাপিস্ট গ্রুপ’ ও ‘কিলার গ্রুপ’ নামে সেময়ের সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুটি অংশ ছিল তৎকালে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অব্যাহত খুন ধর্ষণের ঘটনায় অতিষ্ট ছিল ক্যাম্পাসবাসী সন্ত্রাসীদের দোর্দন্ড প্রতাপে সেসময় প্রতিবাদ করার উপায় ছিলনা নির্যাতিতদের

হঠাৎ কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর ধর্ষণের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হল। এরপর শুরু চাপা ক্ষোভ, যা একপর্যায়ে প্রকাশ্য আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রফ্রন্টসহ প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন সমুহের নেতৃত্বে ‘সাধারণ ছাত্র ঐক্য’র ব্যানারে সংগঠিত হয় প্রথম ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন আন্দোলন চলাকালে ২৩ আগস্ট ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদকে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করে ২৪ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট সদস্য আফরোজান নাহার রাশেদা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্চিত হন অবশেষে সফল এক আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালের আগস্ট ছাত্রলীগের খুনি ধর্ষক গ্রুপকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়

তখন থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয় আগস্ট খুনি-ধর্ষক প্রতিরোধ দিবস এর প্রেক্ষাপটে ক্যাম্পাসে খুন, ধর্ষণ, অন্যায়, নির্যাতন প্রতিরোধে সাধারণ শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট

নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধে আদালতের নির্দেশে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে যৌন নীপিড়ন বিরোধী সেল গঠন করা হয়েছে, তা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল।  বিশেষত, আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণই ছিলো বেশি।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে জাবির প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ‍যৌন নিপীড়ন রিরোধী আন্দোলন, কয়েক দফায় উপাচার্য অপসারণের আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনা বারবার মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘আন্দোলনের ক্যাম্পাস’ বলে পরিচিতি দিয়েছে। যদিও এসব আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে বহু মত বয়েছে। আন্দোলনের বৈধতা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে।


আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতিতে আমরা কিছু নেতিবাচক ঘটনারও উদাহরণ পাই। যেসব ঘটনা স্রেফ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়, সেসব ঘটনা গায়ের জোরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করার মতো ঘটনাও আমারা দেখেছি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে ক্ষমতাশীন ছাত্র সংগঠন ও পুলিশ দিয়ে পেশি  শক্তি প্রয়োগের ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এসব ঘটনা এই সুন্দর ক্যাম্পাসের সুনাম নষ্ট করে দিয়েছে নিমিষেই।

২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগ নব নির্মিত একটি ভবনের ‘জায়গা দখল’ নিয়ে আন্দোলনে নামে। ‍আন্দোলনে শিক্ষকরা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিনরাত বিভাগের করিডোরে বসিয়ে রাখেন ভবন পাহাড়া দেয়ার জন্য। ভাবা যায় একবার, এরাই কিন্তু আমাদের অভিভাবক! এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় তিনমাস বন্ধ থাকে। পিছিয়ে পরে সব বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম। সারা দেশের মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয় এক নেতিবাচক দৃষ্টিতে। বাড়িতে যাই, লোকজন দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তোদের ক্যাম্পাসের জমি দখল ঝামেলা কি মিটছে?’  কি একটা বিব্রতকর অবস্থা!



এখনো আমরা দেখি, যৌক্তিক দাবি পাশ কাটিয়ে কথায় কথায় আন্দোলন আর আন্দোলন। হয়ত এতদসংশ্লিষ্ট সবাই মনে করে আন্দোলনেই সব সময় দাবি আদায় হয়। ঘটনা অবশ্য একদম যে মিথ্যে তেমন না কিন্তু। জোর খাটিয়ে অমূলক দাবিও আদায় করার ঘটনা ঘটে এই প্রায় ৭০০ একরের ক্যাম্পাসে। বিভিন্ন আন্দোলনমুখী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-গবেষণায় মনযোগী না করে ঠেলে দিচ্ছে অযাচিত আন্দোলনের দিকে। এছাড়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ছোট-খাট দাবিতে বড় কর্মসূচীর মতো ঘটনা তো আছেই।

এজন্য অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না। কারণ তাদের মাঝে স্পষ্টভাবে এই প্রবণতা আছে যে, তারা যেটা ভাববে যেন সেটাই ঠিক, অন্যদের দাবি অযৌক্তিক। কেউ কোন দাবি করলে অন্তত তা তো শুনতে হবে- কি বলতে চায় তারা। অধিকাংশ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পাওয়া যায় না প্রাথমিক অবস্থায়। সে এক প্রকার এড়িয়ে চলতে চায়। পরে অবস্থা যখন জটিল আকার ধারণ করে, তখন চলে দোষারোপের খিস্তি।



আর মাত্র চার বছর পরে অর্ধশতকে পা দিবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়টি জন্ম দিয়েছে হাজারো গুণী ও কৃতী সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তবে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি কতটুকু এসেছে সে হিসেব নিকেশ করার সময় এসেছে।

কোন বিষয়ে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামা খারাপ কিছু না। আমি নিজেই যেকোন যৌক্তিক আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করি। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কিন্তু আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকেই সৃষ্টি। তাই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আন্দোলন হতে হবে যৌক্তিক দাবিতে, জনদুর্ভোগ নূন্যতম ও সহনীয় পর্যায়ে রেখে। আর কর্তৃপক্ষকেও সব দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতেকরে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ শিক্ষা-গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সাভারের উঁচুনিচু লালমাটি, অতিথি পাখির অভয়ারণ্য লেক আর সবুজ প্রান্তর নিয়ে ভালো থাকুক প্রিয় লাল-সবুজের শিক্ষা নগরী, ভালো থাকুক জাহাঙ্গীরনগর।

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments

Popular posts from this blog

গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি কী?

গণমাধ্যমের প্রচারণা মডেল ও ফিল্টার

সামাজিক স্তরবিন্যাস