ফেসবুক ব্যবহার: ভালো-মন্দ কতখানি?



ধরুন আপনি কোন ব্যক্তি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে চান, সেক্ষেত্রে কি করবেন? পূর্বেকার দিন হলে হয়তো গুপ্তচর লাগিয়ে দিতেন কিংবা শার্লক হোমস বা প্রাইভেট কোন ডিটেকটিভ নিয়োগ করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার যুগে আপনি কি করবেন? অনেকগুলো কাজই করা যায়। তবে সবচেয়ে সহজ কাজটি হবে, ঐ ব্যক্তির কোন সচল ফেসবুক একাউন্ট আছে কিনা তা খোঁজ নেয়া। এরপরের কাজ শুধু ফেসবুক প্রোফাইলটি অনুসন্ধান এবং ঐ ব্যক্তির কর্মকান্ড অনুসরণ করা। ব্যাস, অল্প সময়ের মধ্যেই তার সম্পর্কে আপনি একটা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন।

কারো সম্পর্কে জানার জন্য এই ‘সহজ’ পদ্ধতিটি অধিকাংশ বৈধ ফেসবুক প্রোফাইলধারীর বেলায়ই প্রযোজ্য হবে, বিশেষত আমাদের বাংলাদেশে। কারণ এখানকার লোকেরা সবচেয়ে বেশি ফেসবুক পাগল। এটা কিন্তু কোন মনগড়া কথা না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশাল’ এবং  কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান ‘হুটস্যুইট’ যৌথভাবে চালানো এক বৈশ্বিক জরিপে উল্লেখ করেন, “পৃথিবীর যে সব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা হচ্ছে দ্বিতীয়অনলাইনে প্রকাশিত বছরের এপ্রিল মাসের হিসেব অনুযায়ী, ঢাকায় সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ মিলিয়ন বা দুই কোটি ২০ লাখ।” [বিবিসি]

অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ বলছে, দেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহার করছে প্রায় কোটি ৩৩ লাখ মানুষ এখানে যতগুলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ৯৯ শতাংশই ফেসবুক ব্যবহারকারী! বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে কোটি ৭০ লাখ পুরুষ আর ৬৩ লাখ নারী এবং সবচেয়ে লক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ৯৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ তরুণ সমাজ। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকের এই বিশাল ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর বড় অংশই হচ্ছে তরুণসমাজ।

কিন্তু ফেসবুককে কিভাবে ব্যবহার করছে এই তরুণ সমাজ?


তরুণ সমাজের ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা হয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ২৭০ কোটির বেশি লোক সক্রিয়ভাবে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্ককে। সাঁই সাঁই করে জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে তার প্রতিষ্ঠানের।




তরুণদের কাছে নিজেদের ভাবনা-চিন্তা তুলে ধরার জন্য ফেসবুক একটি সহজ প্ল্যাটফর্ম। প্রতিদিন তারা কোন ইস্যুকে প্রধান্য দিচ্ছে তা বোঝা যায় এই মাধ্যম থেকে। তাদের কোনো মন্তব্য বা প্রচারণা ভাইরাল হয়, কিংবা কোনো ভিডিও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই যুগে পরিবারের সদস্যদের চেয়ে কমবয়সীরা গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়, আর এই প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকায় থাকে ফেসবুক।

গবেষকেরা রীতিমত গবেষণা চালিয়ে বের করেছেন যে, মাদক তথা মদ-সিগারেটকেনাবলার চেয়ে ফেসবুক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা বেশি কঠিন। এর কারণ ফেসবুকের আসক্তি এমনই যে, মাদক দ্রব্য কোকেন খেলে মস্তিষ্কে যেরূপ প্রভাব পড়ে, ফেসবুকের বেলায়ও তেমনটা ঘটে। আর যারা নাকি দিনের অধিকাংশ সময় এই অনলাইন জগতে কাটান, তাদের জন্য ফেসবুক অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার নামে এক প্রকার মানসিক রোগের কথাও বলেছেন কেউ কেউ।

তরুণ বয়সীরা নিজেকে নিয়ে মেতে থাকার অন্যতম সহজ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে ফেসবুককে। কখন কোথায় বেড়াতে গেল, কি রান্না করল, কি খেল, কীভাবে ঘুমাচ্ছিল, কার সাথে দেখা হল প্রভৃতি নিত্যদিনকার নানা কর্মকান্ড নিয়ে, অনেকসময় ‘প্রয়োজন’ ছাড়াই, হাজার হাজার পোস্ট আসছে ফেসবুকে। আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমরা এত ছবি কেন দাও ফেসবুকে? উত্তরে তারা জানায়, ফেসবুককে তারা অনলাইন এলবাম হিসেবে ব্যবহার করে। কারো কারো সরল স্বীকারোক্তি, সবাইকে জানানোর জন্যই ছবি পোস্ট দেয়া।

ছবি ছাড়াও দিনে কয়েকবার করে স্টাটাস দেয় এমন বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরতে ভালো লাগে। শিক্ষকদের মধ্য থেকে এমন কাজ করেন তেমন দুজন শিক্ষক জানালেন, তারা নির্দিষ্ট বিষয়ে ‘জনমত তৈরিতে’ তাদের ফেসবুক বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য বারে বারে এসব পোস্ট দেন। বিষয়টিকে আমরা গণমাধ্যমের ‘অপিনিয়ন লিডার’ এর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারি, যদিও দিনশেষে এই মতমোড়ল কার্যক্রম কতটুকু সফল হয়, তা আসলে আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু একটা কথা আমার কাছে মনে হয়, এসব আচরণের ব্যাখ্যা যেটাই দেয়া হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সারাক্ষণ ‘আমিত্ব’ নিয়ে মেতে থাকতে পারার দুর্দান্ত উত্তেজনা থেকেই এই বেশি বেশি ফেসবুক ব্যবহার।

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিয়ে কাজ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কনটেন্ট ম্যাটার্স’  ঢাকাস্থ এই প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী বিশেষ করে তরুণদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে  এসব তথ্য তারা নানা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী রফিকুল্লাহ রোমেল বলেন, “আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করেন, বিশেষ করে তরুণরা, তাদের  শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা অনুভূতি শেয়ার করেন। শেয়ার করে তারা তাদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটাতে চান, অবস্থার জানান দিতে চান। তবে এটা করতে গিয়ে কেউ কেউ ভাষার ব্যবহার বা ছবি কনটেন্ট ব্যবহারে অসতর্কতার পরিচয় দেন, অথবা অসততা করেন।” 

ইতিবাচক বনাম নেতিবাচক 

ফেসবুকের ইতিবাচক ব্যবহারের দিকটি বেশ বড়। কিন্তু নেতিবাচক দিকটিও নেহায়েত কম নয়। আমরা জানি আমাদের চারপাশেই ফেসবুকের কতশত হাজারো অবৈধ ব্যবহারকারীর রয়েছে। দু-একটি মজার নাম তো শেয়ার করাই যায়- ‘রাজুর বউ ভাগলো কেন?’, ‘বাংলার আমজনতা’, ‘আমি সিঙ্গেল’, ‘প্রেমিক চাই’ ব্লা ব্লা ব্লা। আলোচনার শুরুতে ইতিবাচক কিছু দিক নিয়ে বলে নেই।

তরুণরা এখন ফেসবুক ব্যবহার করছে পড়াশুনা, সমাজ সেবা, রক্তদান, সামাজিক ক্যাম্পেইন, সৃজনশীল বিভিন্ন কাজে। ব্যবসার জন্যও ফেসবুক ব্যবহার করছে তরুণ উদ্যোক্তারা, আর ফেসবুকে তাদের এমন গ্রুপগুলা সফলও হচ্ছে। মূলত কাজের জন্য মানুষের সাথে নেটওয়ার্কিং করার প্রধান মধ্যম হিসেবে ফেসবুককেই বেছে নেয় তরুণরা।

সিটিজেন জার্নালিজমের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম এখন ফেসবুক! আগে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সমসাময়িক অবস্থা, সামাজিক-প্রশাসনিক অসঙ্গতি নিয়ে ব্লগে লিখতেন, এখন তা ফেসবুক স্টাটাসেই লিখেন।

আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামলকান্তির অবমাননার প্রতিবাদ তরুণরাই প্রথম করেছে ফেসবুকে। তারপর সেই অবমাননার ভিডিও এবং ছবি ভাইরাল হলে সক্রিয় হয় মেইন স্ট্রিম মিডিয়া। অ্যাকশনে যায় রাষ্ট্র। সিলেটে শিশু রাজন হত্যার বিচারও সম্ভব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের তরুণ অ্যাক্টিভিস্টদের কারণে। আর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কথা তো সবারই জানা। ফেসবুক ব্যবহারকারী তরুণরাই এই আদোলন গড়ে তুলেছিলেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে।

ইতিবাচক দিকটি প্রচুর রয়েছে ফেসবুকের, আমি কিছু নেতিবাচক দিকের আলোচনা করব এবারে।কনটেন্ট ম্যাটার্স'- এর প্রধান নির্বাহী রফিকুল্লাহ রোমেল বলছেন, “তরুণদের একাংশ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, ব্ল্যাকমেল করতে সামাজিক যোগযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে। এমনকি রাজনৈতিক বিতর্কে ফেসবুকে তারা চরম আপত্তিকর আচরণ করে থাকে!”

“রক্ত দেয়ার আহ্বানের চেয়ে একটি বিতর্কিত বা অনাকাঙ্কিত পোস্টে তরুণরা সাড়া দেয় বেশি, যা আতঙ্কের।”


ফেসবুকে তরুণদের নেতিবাচক কর্মকান্ডের বৈশ্বিক কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ফ্রান্সের ১৯ বছর বয়সি এক তরুণী ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা সে পেরিস্কোপ অ্যাপের সাহায্য সরাসরি প্রচার করেছিল। ঘটনাটি ২০১৬ সালের মে মাসের।  

যুক্তরাষ্ট্রের ১২ বছর বয়সী এক মেয়ে তার আত্মহত্যার ভিডিও ইন্টারনেটে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। কেটলিন নিকোল ডেভিস নামের তরুণীটি গত ৩০ ডিসেম্বর গাছের ডালের সঙ্গে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে। এরকম ঘটনা বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকার উত্তরা এলাকায় এক কিশোর হত্যার ঘটনায় তরুণদের ফেসবুক ব্যবহারের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।  তারা ফেসবুক পেজ খুলে গড়ে তোলো নানা সন্ত্রাসী গ্রুপ। আবার ধানমন্ডিতে এক কিশোরকে আরেক কিশোর গ্রুপকে মারধর করে তার ভিডিও আপলোড করে দেয় ফেসবুকে।

তরুণদের বিরুদ্ধে ফেসবুক ব্যবহার করে তরুণীকে প্রেমের কথা বলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ এবং হত্যা, ব্ল্যাক মেইল করা পর্নোগ্রাফি ছড়ানোরও অভিযোগ আছে।

অশ্লীলতা প্রচার ও প্রসারের একটি ‘জনপ্রিয়’ মাধ্যমও এখন ফেসবুক। তরুণরাই কিন্তু এই কাজের মূল হর্তাকর্তা! আমরা দেখেছি ক্রিকেটার নাসিরের বোনকে নিয়ে কি ধরনের বাজে মন্তব্য করা হয়েছে। আমি অশ্লীল মনন্তব্যকারীদের অনেকের প্রোফাইলে ঢুকে দেখেছি তাদের অধিকাংশের বয়স দেয়া আছে ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এছাড়া আমরা বিভিন্ন ফেসবুক লাইভে দেখি অশ্লীল ভাষার ব্যবহার। 
উদ্বেগজনক কথা হচ্ছে, বিতর্কিত বা অনাকাঙ্কিত পোস্টে তরুণরা সাড়া দেয় বেশি, যা আসলেই আতঙ্কের।
তরুণ সমাজ ফেসবুক ব্যবহারে আরো নেতিবাচক অনেক চর্চা করছেন। আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহারে কারো ব্যক্তিগত জীবন থাকে না। আমরা ফেসবুকে পরীক্ষার প্রশ্নফাসের ঘটনা দেখেছি। এই ঘটনা তরুণ সমাজের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অবশ্যই। যদিও তরুণরাই ছিলো এর প্রধান সমালোচক। 

বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারের ছাত্রছাত্রী তরুণ-তরুণীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলো কিছুদিন পূর্বেই। পরে অনেক সমালোচনা শুরু হলে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে তারা। কিন্তু সরে আসলেও রাত জেগে ফেসবুক ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশনা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ঘটনা কিন্তু সত্য।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফেসবুকে পাওয়া তথ্য ব্যবহারকারীরা অবলীলায় বিশ্বাস করে ফেলে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকেরা ফেসবুকের পাওয়া তথ্যকে অকাট্য সত্য বলে ধরে নেন! এবং এ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমি নিজেই হয়েছি। ফলে ভুল তথ্য পরিবেশনে স্বার্থ গোষ্ঠী সাধারণ জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করে তাদের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করে। এছাড়া ফেসবুকে গুজব ছড়ানো, ভুল তথ্য পরিবেশনের ঘটনা নৈমত্যিক বিষয়। আমরা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সাঈদীর ফাসির আদেশের পরে দেখেছিলাম, চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখতে পাওয়ার মতো বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর চেষ্টাকে।

ইদানিং শুরু হয়েছে ‘সেলফি রোগ’। রোগ বলছি কারণ, অনেকের ক্ষেত্রে এটি মাত্র ছাড়িয়ে রোগের পর্যায়ে চলে যায়। আত্মপ্রচারের এই প্রবণতা বাস্তব জীবনে সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, ব্যক্তি নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে থাকে। রিফ্রেশমেন্টের জন্য কোথাও ঘুরতে গেলে আগে সেলফি তুলে আপলোড করো, সেমিনারে মনযোগ নেই, মনযোগ থাকে সেলফি তোলায়। রাজনৈতিক নেতার সাথে লেফি তুলতে পারলে তো অনেকে জীবনটাকেই ধন্য মনে করেন।

ফেসবুকে ভুল বানান চর্চা আরেকটি বড় নেতিবাচক দিক। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই ‍অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি, তারা বানান ব্যবহারে সচেতন না। একটা স্টাটাসে অনেকগুলো করে বানান ভুল থাকে। ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে দেখেছি, ‘ছাত্র’ বানান লিখে ‘ছাএ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ বানান লিখেছে ‘বঙগবন্ধু’, ‘ঢাকা যাই’ কে লিখে ‘ঢাকা যায়’। অঞ্চলিক শব্দটিই শেষ পর্যন্ত লেখা হয়ে যায় তাদের। অথচ তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী! 

তাহলে সমাধান কি? 


ব্যবহারকারীদেরে একটা বৃহৎ অংশের এ ধরনের দায়-দায়িত্বহীন সম্পর্কের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের ক্রমশ জনপ্রিয়তা আমাদের অবনতিশীল সামাজিক সম্পর্কের দৈন্যদশা তুলে ধরছে কি-না তা মনোবিজ্ঞানীদের ভেবে দেখা দরকার। এ অবনতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরো অনেক গবেষণা প্রয়োজন।

একজন ছেলে বা মেয়ে যখন বড় হচ্ছে, অর্থাৎ তরুণ সময়টাতে সে কিভাবে তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছে তার উপর অনেকখানি নির্ভর করে তার মস্তিষ্কের গঠনটি কেমন হবে। তাই একজন বড় মানুষের ফেসবুক আসক্তি দেখে যতটুকু বিচলিত হই, তার থেকে অনেক বেশি বিচলিত হওয়ার কারণ রয়েছে কমবয়সী একটি ছেলে বা মেয়ের আসক্তি।

অধ্যাপক জাফর ইকবাল তার এক লেখায় এই আসক্তিকেই নেশা দ্রব্যের সাথে তুলনা করে বলেছন, “আমার ধারণা আজ থেকে চার-পাঁচ বছর পর সারা পৃথিবীতেই কমবয়সী ছেলেমেয়েদের ফেসবুক জাতীয় অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে নিরুৎসাহিত করার জন্যে আইন কানুন করা হবে, প্রচারণা করা হবে ফেসবুকে লগ ইন করার সাথে সাথে প্রথমেই এটাকে আসক্ত হয়ে গেলে কী কী ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে যেতে পারে, সেটা নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হবে। ঠিক যেমনটা করা হয় সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে।”

সুতরাং তরুণ অবস্থায় সন্তানরা কিভাবে এসব সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছে সম্ভব হলে সে বিষয়ে নজর রাখা দরকার অভিভাবকদের। এই মাধ্যম ব্যবহারের নেতিবাচক দিক নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার কাজটি শিক্ষকরাও নিতে পারেন। তরুণদের জন্য ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় না কাটিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা সর্বোপরি ফেসবুকের ইতিবাচক দিকটির উল্টোপিঠে এই যে একটি অবক্ষয়ের চিত্র রয়েছে সেটি মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরী।

তথ্যসূত্র:

Comments

Popular posts from this blog

গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি কী?

গণমাধ্যমের প্রচারণা মডেল ও ফিল্টার

সামাজিক স্তরবিন্যাস