সংবাদ একটি পণ্য ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন
আদি সমাজে কর্মের বিভাজনের দিক থেকে দুই ধরনের লোক ছিল। একদল সমাজিক বিষয় নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দায়িত্ব নেয়, অন্যদল শারিরীক শ্রম দিত। সেই সমাজে এধরনের কর্মের বিভাজন ছিল, কিন্তু সম্মানের বিভাজন ছিল না। একপর্যায়ে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করত তারা নিজেদের অধিক সম্মানিত দাবী করল। এভাবে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য শুরু হল। সামজের এই অংশের দ্বারাই এবং মুলত এই অংশের সুবিধার জন্যই আমলাতন্ত্রের উদ্ভব।
আমাদের মানতে কষ্ট হলেও এটাই ঠিক যে টুথপেস্ট, সাবান, পারফিউম কিংবা মেবাইল ফোনের মতই সংবাদও একটি পণ্য, একইসাথে এটি একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন।
কারখানায় এই পণ্য প্রতিদিন উৎপাদন করা হয়, যার উদ্দেশ্য মুলত মুনাফা অর্জন এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। সামাজিক প্রভাবক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের কথা মাথায় রেখেই সংবাদের অ্যাঙ্গেল ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়। মিডিয়া মালিকরা প্রথমে মিডিয়াতে বিনিয়োগ করে। তারপর এখানে সংবাদকে দিয়ে ব্যবসা করে। প্রথমে তারা পাঠক তৈরি করে, এরপর এই পাঠকদের বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়।
সংবাদপণ্যের বাজার মুলত দুইটি। প্রথমত সংবাদমাধ্যম অডিয়েন্সের কাছে সংবাদ বিক্রি করে। দ্বিতীয়ত, এই অডিয়েন্সকে আবার বিক্রি করে দেয় বিজ্ঞাপনদাতা ও নানামুখী স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর কাছে। ফলে সংবাদ বিক্রির মাধ্যমে এমন এক শ্রেণীর অডিয়েন্সকে ধরতে হয়, ক্ষেত্রবিশেষ তৈরি করতে হয়, যাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিজ্ঞাপনদাতা ও স্বার্থগোষ্ঠীগুলো আগ্রহী হবে- পণ্য বিক্রি ও সম্মতি উৎপাদনের স্বার্থে।
সংবাদ পণ্যে পরিণত হয়েছে বিধায় আমরা আজকে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সংবাদের চেয়ে বিজ্ঞাপন বেশি দেখি। সংবাদ পণ্য হওয়ায় এদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, অর্থনীতির মুল চালিকাশক্তি কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, সাফল্য, সুবিধা-অসুবিধার সংবাদ আমরা খুব কমই দেখতে পাই। কারণ তাদের নিয়ে তৈরি সংবাদ বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলি, টিভি চ্যানেলগুলোতে সবাই রাজনৈতিক, বিনোদন, খেলার সংবাদ বেশি দেখে। কিন্তু খুব কম সংখ্যক দর্শকই সময় নষ্ট করে কৃষি সংবাদ দেখে। তাই এই প্রকারের সংবাদপণ্য থেকে লাভও বেশি আশা করা যায় না।
সুতরাং আজকের সংবাদমাধ্যমের মুল লক্ষ্য যেহেতু মুনাফা অর্জন, তাই সংবাদ মানেই পণ্য চরিত্র পেতে বাধ্য। সংবাদ প্রতিষ্ঠান মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে সবচেয়ে কম খরচে সংবাদ-পণ্য উৎপাদন করতে চায়। ফলে নিয়মিত সংবাদ পাওয়ার জন্য তারা বড়লোক, সরকার কিংবা কর্পোরেশনের ওপর নির্ভর করে।
মার্কিন অধ্যাপক এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোম চমস্কি মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া সম্পর্কে তাদের গড়ে তোলা প্রভাবশালী ‘প্রচারণা মডেল’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘আধিপত্যশীল মিডিয়া সংস্থাগুলো অনেক বড় আকরের ব্যাবসা। এই মিডিয়াগুলো ঘনিষ্ঠভাবে আন্তসম্পর্কিত এবং অন্যান্য প্রধান কর্পোরেশন, ব্যাংক ও সরকারের সঙ্গে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সমস্বার্থগত সম্পর্ক রয়েছে। এই স্বার্থ প্রবলভাবে নির্ধারণ করে দেয় মিডিয়াতে কোনটি সংবাদ হবে আর কোনটি হবে না।” মিডিয়ার এই আমলাতান্ত্রিক রূপ এখন বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান।
বিনোদন প্রতিষ্ঠান বা অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের মতো সংবাদমাধ্যমও সফলভাবে তথ্য সংগ্রহ, সংবাদকাহিনী নির্মাণ ও প্রকাশের জন্য সাংগঠনিক কাঠমো ও প্রক্রিয়া গড়ে তোলে। এজন্য সংবাদপ্রতিষ্ঠান আমলাতান্ত্রিক চরিত্র পায়। আর সংবাদ হয়ে ওঠে প্রাত্যহিক আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল। কোন বিষয়টি কভার করা হবে, কোন তথ্যগুলো কাভার করা হবে এসব নিয়ে সংবাদ প্রতিষ্ঠানে সবসময় অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। আর এই অনিশ্চয়তা মোকাবেলা করা হয় সবকিছু একটি কাঠামোর মধ্যে ফেলে দিয়ে। এই কাঠামো অনুযায়ী সংবাদকে নানান ভাগে ভাগ করা হয়, রুটিনমাফিক কিছু নির্দিষ্ট স্থানে সবসময় রিপোর্টার রাখা হয়। এভাবে সংবাদ উৎপাদনকে রুটিনবদ্ধ করায় আমরা সব মিডিয়ায় প্রতিদিন একই ধরনের সংবাদ পেয়ে থাকি।
সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও আমলাতান্ত্রিক কাঠামো বিদ্যমান। এখানে আমলাতান্ত্রিক নিয়মের মত সম্পাদক বা মালিকের কথাতেই সব চলে। এই কাঠামোর বাইরে গিয়ে কেউ কোন কথা বলতে বা সংবাদ প্রচার করতে পারে না।
সংবাদ-আমলাতন্ত্র আবার তথ্যের জন্য অন্য আমলাতন্ত্রগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকে। গবেষক মার্ক ফিশম্যান তাই বলেছেন, ‘সাংবাদিকের বিশ্ব আমলাতান্ত্রিকভাবে সাজানো’। সাংবাদিকদের আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল- আমলাতন্ত্রগুলো নিয়মিত সংবাদ-ঘটনা সরবরাহ করে, যা সংবাদ প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের খরচ বিপুলভাবে কমিয়ে দেয়।
মার্ক ফিশারম্যান সংবাদের এই অবস্থাকে বলেছেন, ‘আমলাতান্ত্রিক ঐক্যের নীতি’। কেবল অন্য কোন আমলাতন্ত্রই পারে সংবাদ আমলাতন্ত্রকে কাঁচামাল সরবরাহ করে তৃপ্ত করতে। এভাবেই সংবাদ পণ্য হওয়ার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানেরও উৎপাদন হয়ে যায়।
Comments
Post a Comment